মালয়েশিয়ায় রিলোকেশন ৬ - ট্যাক্স বিষয়ক

মালয়েশিয়ায় রিলোকেশন ৬ - ট্যাক্স বিষয়ক

প্রিয় পাঠক, মালয়েশিয়ায় আসা এবং চাকরি শুরু করার পর সবার একটা কমন প্রশ্ন থাকে। সেটা হল নন-রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম ৬ মাস যে অতিরিক্ত টাকা কেটে নিয়েছে সেটা কবে ফেরত দেওয়া হবে। ফেরত দিলেও কিভাবে, কত টাকা ফেরত দিবে ইত্যাদি প্রশ্ন তো থেকেই যায়। তো এই পর্বে চলুন দেখে নিই কিভাবে আপনি বছর শেষে ট্যাক্স ফাইল করবেন এবং রিফান্ড ক্লেইম করবেন।

প্রথমেই বলে নিই রেসিডেন্সি স্ট্যাটাস কি। মালয়েশিয়ায় আপনি সর্বমোট যে কয়দিন ধরে বাস করছেন, তার যোগফল যদি ১৮২ বা তার চেয়ে বেশী হয়, তাহলে আপনাকে রেসিডেন্সি স্ট্যাটাস দেওয়া হবে। এই ১৮২ দিনের মাঝে আপনি চাইলে বাংলাদেশ বা অন্যকোন দেশে থাকতে পারেন। আপনি যতদিন না রেসিডেন্সি স্ট্যাটাস পাচ্ছেন, ততদিন আপনাকে ২৮% নন-রেসিডেন্ট ট্যাক্স (২০২০ এর হিসাব অনুযায়ী ৩০%) পে করতে হবে। আপনার কোম্পানিই আপনার বেতন থেকে এই এমাউন্ট কেটে নিবে প্রতিমাসে। ধরে নিন আপনি মালয়েশিয়ায় এসে জব শুরু করলেন মার্চ মাসের ১ তারিখ থেকে। আপনার বেতন ১০০০০ রিংগিত। তাহলে মার্চ-আগস্ট মাস পর্যন্ত আপনি বেতন পাবেন ৭০০০ রিংগিত। আর বাকি ৩০০০ রিংগিত x ৬ = ১৮০০০ রিংগিত ফেরত পাবেন ওই বছরের ট্যাক্স ফাইল সাবমিট করার পর।

কিংবা মনে করেন আপনি ১ মার্চ থেকে চাকরি শুরু করেছেন। কিন্তু জুন মাসে ১৫ দিন আপনি বাংলাদেশে ছিলেন। তাহলে আপনার রেসিডেন্সি স্ট্যাটাস আসবে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি। সুতরাং সেপ্টেম্বর মাসের পে-রোলেও আপনাকে ৩০% ট্যাক্স দিতে হবে।

এখন কথা হল, এই অতিরিক্ত ট্যাক্স কিভাবে ফেরত পাবেন? ফেরত পেতে হলে ২টা শর্ত আছে।

১। পরবর্তী বছরে আপনাকে বর্তমান বছরের ট্যাক্স ফাইল সাবমিট করতে হবে (মালয়েশিয়ায় জানুয়ারী-ডিসেম্বর অর্থবছর ধরা হয়) ২। যে বছরের ট্যাক্স ফাইল সাবমিট করবেন ওই বছরের ডিসেম্বর মাসের ৩১ তারিখের আগে আপনাকে রেসিডেন্সি স্ট্যাটাস পেতে হবে।

তার মানে হচ্ছে, আপনি যদি আগস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে মালয়েশিয়ায় চাকরি শুরু করেন, তাহলে ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে আপনার রেসিডেন্সির ১৮২ দিন পূরণ হবেনা।

এবার চলুন জেনে নেই ট্যাক্স ফাইল সাবমিট কিভাবে করবেন।

ট্যাক্স ফাইল সাবমিট করা

ট্যাক্স নাম্বার খোলা আর ট্যাক্স ফাইল সাবমিট করা যে আলাদা বিষয় তা সম্ভবত সবাই জানেন। আপনি যে কোম্পানিতেই চাকরি শুরু করুন না কেন, প্রথম মাসের পে-রোলের আগেই আপনাকে দিয়ে তারা ট্যাক্স নাম্বার (TIN) খুলিয়ে নিবে। রেজিস্ট্রেশনের সময় আপনার HR আপনাকে দরকারী কিছু তথ্য দিবে যেগুলা রেজিসট্রেশনের জন্য দরকারী যেমন Employer Number বা No. Majikan ইত্যাদি।

ডিসেম্বর মাসে ট্যাক্স ইয়ার শেষ হলে পরবর্তী বছরের শুরুতে কোম্পানি আপনাকে একটা ফর্ম দিবে যেটাকে বলে EA Form (Employee's Aggregated Payroll). এই ফর্মে উক্ত অর্থবছরে কোম্পানি আপনাকে কত টাকা বেতন দিয়েছে এবং কত টাকা ট্যাক্স কেটেছে তার হিসাব দেওয়া থাকবে। কোম্পানি যদি নন-রেসিডেন্ট ট্যাক্স হিসাবে ৩০% কেটে রাখে তাহলে সেটাও এই ফর্মে উল্লেখ থাকবে।

তো ফেব্রুয়ারী মাসের মাঝেই আপন আগের বছরের EA ফর্ম পেয়ে যাবেন। এখন এই ফর্মের ডাটা ও অন্যান্য ট্যাক্স রিবেটের হিসাব আপনাকে অনলাইনে আপলোড করতে হবে। সাধারণত এই কাজটা সহজেই ezHASiL থেকে করা যায়। এটা হল LHDN এর অনলাইন পোর্টাল যেখানে আপনি ট্যাক্স ফাইল করা, আগের বছরের হিসাব দেখা ইত্যাদি সব কাজ করতে পারবেন।

ezHASiL এ লগিন করতে হলে শুরুতেই আপনাকে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। রেজিস্টার করতে চলে যান এই লিংকে। ১৬ ডিজিটের পিন নম্বরটা কোথায় পাবেন? এইটা পেতে হলে আপনাকে আপনার নিকটস্থ বা রেজিস্টার্ড LHDN অফিসে যেতে হবে। আমি সাজেস্ট করব মার্চ মাস শুরু হবার আগেই চলে যান। ওই সময়টায় ভীড় কম থাকে। সাথে পাসপোর্ট নিয়ে যান। অফিসে পৌঁছে কাস্টমার সাপোর্ট খুঁজে বের করুন। বলুন যে আপনি ezHASiL এ রেজিস্ট্রেশন করতে চান। তারা আপনার পাসপোর্ট দেখে বা TIN দেখে আপনাকে পিন নম্বরটা প্রিন্ট করে দিবে। ওই ১৬ ডিজিট পিন দিয়ে আপনি রেজিস্ট্রেশন করে ফেলুন।

তাহলে আপনার হাতে আছে কোম্পানির দেওয়া EA ফর্ম, আর আছে অনলাইন ezHASiL একাউন্ট। তাহলে আর দেরী কেন? e-Filling এর সময় শুরু হলে অনলাইনেই যাবতীয় তথ্য পূরণ করে জমা দিয়ে দিন। অনলাইনে আয়, ব্যায়, সঞ্চয় ইত্যাদির যে হিসাব জমা দেওয়া হয়, সেটাকে বলে eBE Assesment. এই ফর্ম পূরণের সময় আপনার ব্যাংক একাউন্ট নম্বর চাওয়া হবে। বুঝতেই পারছেন, কোন অতিরিক্ত ট্যাক্স কাটা হয়ে থাকলে সেটা ওই ব্যাংক একাউন্টে রিফান্ড করে দেওয়া হবে।

eBE Assesment শেষে আপনাকে একটি Acknowledgment ফর্ম দেওয়া হবে যেটায় সংক্ষিপ্ত আকারে আপনার এক বছরের আয়, ট্যাক্স, রিফান্ড ইত্যাদি দেওয়া থাকবে। প্রতিবছর এই ফর্মটি আপনার প্রয়োজন হতে পারে (চাকরি বদলের সময় বা ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স নিতে হলে)। তাই সেটা সযত্নে সংরক্ষণ করুন।

আমার ক্ষেত্রে মার্চ মাসে eFilling করার পর ট্যাক্স রিফান্ড পেতে সময় লেগেছিল প্রায় দুইমাস। সঠিকভাবে ফাইল সাবমিট করার পরেও রিফান্ড না পেলে আপনার LHDN ব্রাঞ্চে গিয়ে অথবা তাদের ইমেইলে যোগাযোগ করতে পারেন। সাধারণত LHDN এর ওয়েবসাইটে প্রতিটা ব্রাঞ্চের অফিসারদের নম্বর ও ইমেইল দেওয়া থাকে। আমার ক্ষেত্রে ইমেইল করে আমি রিফান্ড বিষয়ে দ্রুত সমাধান পেয়েছিলাম।

ট্যাক্স রিলিফ পাওয়া

বাংলাদেশের মতই মালয়েশিয়াতে বিভিন্ন খাতে খরচ করে আপনি কর রেয়াত বা ট্যাক্স রিলিফ পেতে পারেন। যেমন বিবাহিত হলে আপনার করযোগ্য আয় থেকে ৪০০০ রিংগিত, সন্তান থাকলে ২০০০-৮০০০ রিংগিত, ইনসুরেন্স বা EPF কনট্রিবিউশন থাকলে ৬০০০ রিংগিত ইত্যাদি ছাড় রয়েছে। আরেকটি আকর্ষণীয় খাত হল লাইফ স্টাইল ক্যাটাগরিতে ২৫০০ রিংগিত পর্যন্ত ছাড় পাওয়া। আমি সাজেস্ট করব নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করতে।

  • ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন ক্রয়

  • ইন্টারনেট কানেকশনের মাসিক বিল

  • জিম বা অন্য স্পোর্টস ইকুইপমেন্ট (যেমন ট্রেড মিল)

  • আপনার বা স্ত্রী/সন্তানদের মেডিকেল চেকআপের ফি

উক্ত খরচের স্লিপ বা ইনভয়েস থাকলে সেগুলোর এমাউন্ট যোগ করে eBE Assesment এর জায়গামত বসিয়ে দিন। তবে LHDN চাইলে যেকোনসময় এই ডকুমেন্টস দাবি করতে পারে। এজন্য EA ফর্ম ও ট্যাক্স রিলিফের কাজে ব্যাবহৃত সকল ডকুমেন্টস সযত্নে রেখে দিতে হবে। প্রয়োজনের সময় এসব ডকুমেন্ট দেখাতে না পারলে বড় অংকের জরিমানার ব্যাবস্থাও আছে।

সবরকম খাত ও কর রেয়াতের পূর্ণাঙ্গ লিস্ট দেখতে পারেন এইখানে

ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স নেওয়া

ক্ষেত্রবিশেষে আপনাকে ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স নেওয়া লাগতে পারে। যেমন চাকরি বদল, অন্য দেশে রিলোকেশন নেওয়া, মালয়েশিয়া থেকে স্থায়ীভাবে চলে যাওয়া ইত্যাদি।

মূলত ট্যাক্স রিলেটেড সব কাজে আপনার কোম্পানির HR ই সব কাজ করবে। কিন্তু আমার মত যদি কখনও এমন হয় যে কোম্পানির বেহাল দশা এবং HR নেই, তখন নিজে নিজে আপনি ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স নিতে পারেন।

আমি মূলত মালয়েশিয়া থেকে চলে যাওয়ার সময় যে ক্লিয়ারেন্স লাগে সেটার বিষয়ে বলব। মালয়েশিয়ায় থাকা কোন ফরেনার যদি স্থায়ীভাবে চলে যেতে চায়, তাহলে তাকে CP21 ফর্মসহ LHDN ব্রাঞ্চে গিয়ে এপ্লাই করতে হবে। অনলাইনে এপ্লাই করতে হলে ezHASiL এ লগিন করে e-SPC অপশনে গেলেই আপনি CP21 ট্যাব দেখতে পাবেন।

অনলাইনে এপ্লিকেশন করাটা বেশ সহজই। বেশীরভাগ অপশনই আপনার লাস্ট EA ফর্ম অনুযায়ী আপডেট হয়ে থাকবে। শুধুমাত্র যে বছরে আপনি ক্লিয়ারেন্স নিচ্ছেন ওই বছরে আপনার পে-রোলে কত টাকা ঢুকেছে সেটা বসালেই হবে। আসলে LHDN এর কাছে প্রতিমাসে আপনার নামে কত টাকা ট্যাক্স জমা হচ্ছে সেটার হিসাব আছেই।

অনলাইনে এপ্লিকেশন করলেও আরো কিছু ডকুমেন্টস আছে যেগুলা আপনাকে নিজে জমা দিতে হবে। সেগুলো হল

  • আপনার পাসপোর্টের সকল পেজের ফটোকপি (মাস্ট, মূল কপিও সাথে নিতে হবে ভেরিফিকেশনের জন্য)

  • আপনার স্ত্রী বা সন্তান থাকলে তাদের পাসপোর্টের বায়ো ও ভিসা পেজের ফটোকপি (ডিপেন্ডেন্ট থাকলে মাস্ট)

  • আপনি মালয়েশিয়ায় কোন বছর কত তারিখে প্রবেশ করেছেন এবং কত তারিখে বের হয়েছেন তার সম্পূর্ণ টাইমলাইন (পাসপোর্টে এয়ারপোর্টের সীল দেখে এটা হিসাব করতে পারবেন)

  • সে বছরে ক্লিয়ারেন্স নিচ্ছেন ওই বছরের BE ফর্ম (অফিস থেকেই দেওয়া হবে)

  • আপনার কোম্পানি থেকে পাওয়া শেষ EA ফর্ম (আগের বছরের গুলাও লাগতে পারে)

  • সম্ভাব্য যাত্রার তারিখ ও টিকেট (যদি থাকে)

উপরের কাগজপত্র গুলো রেডি করে চলে যান আপনার রেজিস্টার্ড LHDN ব্রাঞ্চে। সেখানে কাস্টমার কেয়ার বিভাগে গিয়ে বলুন আপনি ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স নিতে এসেছেন। তারা আপনাকে দায়িত্বরত কোন অফিসারের কাছে ফরোয়ার্ড করে দিবে। অফিসারকে আপনার সকল কাগজপত্র বুঝিয়ে দিন। উনার সাহায্য নিয়ে Malaysia Exit/Entry Information এবং BE Assessment ফর্ম পূরণ করে জমা দিয়ে দিন। সব ঠিকঠাক থাকলে ১০-১৫ কর্মদিবসের মাঝে আপনার ইমেইলে এবং পোস্টাল এড্রেসে ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স পৌঁছে যাবে।

আশা করি পোস্টটি আপনাদের কাজে লাগবে। মালয়েশিয়ান ট্যাক্স রিলেটেড কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট বক্সে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। ধন্যবাদ।